এই ঘুরে বেড়ানোর মৌসুমে আমাদের মাথায় কিছু প্রশ্ন অবধারিতভাবে আসে, যেমন, বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অবস্থা এমন লেজেগোবরে কেন? দেশ বিদেশের ঘুরঞ্চি লোকজন কি ঝোলা কাঁধে নিয়ে দলেবলে আসবে না? এদিক সেদিক ঘুরতে গিয়ে একটু ভালো সার্ভিস কি আমরা পাবো না? এসবের কি কোন উন্নতি হবে না? এই প্রশ্নগুলোর ফাঁকে দিয়ে উঁকি দেওয়া স্বপ্নে জল ঢেলে দেওয়ার মত দুইটা মতামত আছে আমার, প্রথমটা হলো, না, হবে না; আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, হওয়ার দরকারও নাই।
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প বিকাশ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এর প্রধান কারণ ৩ টা। এগুলোর মধ্যে মদ এবং ফুত্তিফাত্তার সহজলভ্যতার কোন সম্পর্ক নাই। কারণগুলো আমাদের একদম মজ্জাগত, আপপৌরে, সাংস্কৃতিক।
২। আমাদের সার্ভিস মেন্টালিটিই নাই। আমরা সেবা দিতে জানি না। লাত্থিগুতা, গালাগালি খেয়ে, মুখ বুঁজে নোংরা ময়লা সাফ করে, হাসিমুখে সেবা দিয়ে, বখশিশের জন্য হাত না কচলিয়ে, সঠিক দামটা নেওয়ার কাজ বাঙালিকে দিয়ে হয় না। এই অভ্যাসটা আপদমস্তক পরির্তন না হলে পর্যটন ব্যবসা হবে না।
২। “সংরক্ষণ” আমাদের স্বভাবে নাই। ইতিহাস, পরিবেশ, সংস্কৃতি, স্থাপত্য কিছুই আমরা ধরে রাখি না। আমরা “উন্নয়ন” করে ফেলি। দৃষ্টিনন্দন পুরোনো ভবন নির্বিচারে ভেঙ্গে ফেলি, শান্তিপূর্ণ গ্রামগুলোকে নোংরা ঘিঞ্জি মোফস্সলে পরিণত করি, সুযোগ পেলোই গাছপালা, খাল, নদি খেয়ে ফেলি; আর ভাবি বিদেশি পর্যটক বুঝি আমাদের সিঙ্গাপুরে পরিণত হওয়ার উন্নয়ন দেখতে আসবে! এর চেয়ে হাস্যকর চিন্তা আর দ্বিতীয়টা হয় না। উন্নয়ন দেখতে বাংলাদেশে আসার কোন দরকার নাই কারও। একজন বিদেশি পর্যটকের গুলশান-বনানী দেখার কোন আগ্রহ থাকার কারণ নাই। তারা চিরায়ত গ্রাম দেখতে চায়, দাঁড় বাওয়া পাল তোলা নৌকায় চড়তে চায়, পুরোনো দালান, কারুকাজ করা মসজিদ মন্দির দেখতে চায়, বন-জঙ্গল পশু-পাখি দেখতে চায়, যাত্রা-পালা, বাউল গান শুনতে চায়—আমরা উন্নয়ন করে এগুলো সব ধ্বংস করে সিমেন্টের হাতি ঘোড়া বানিয়ে ভাবছি খুব পর্যটন হচ্ছে!
৩। আমাদের সমাজ পর্যটন বান্ধব না। অন্যের কর্মকাণ্ডে নাক গলানো, কৌতুহলী হয়ে হাভাইত্তার মত চেয়ে চেয়ে দেখা—এগুলো আমাদের জাতীয় বিনোদন! এগুলো পর্যটন বান্ধব আচরণ না। তবে এই অভ্যাসগুলোর ভালো দিকও আছে। এই বিপুল জনঘনত্বের দেশে সব কিছু যে পরিমাণ রসাতলে যাওয়ার কথা ছিলো বাংলাদেশে সে পরিমাণ খারাপ অবস্থা হয় না। এর একটা কারণ হলো এই নাক গলানো কৌতুহলী অভ্যাস—এতে সমাজের গিট্টু আঁটোসাঁটো থাকে। সবকিছু চোখে চোখে থাকে। কুটনামি কিন্তু সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ বন্ধন। বিপুল পরিমাণে পর্যটকের আনাগোনা সমাজের এই বন্ধনগুলো ঢিলা করে দেয়। পর্যটনমুখী যে কোন সমাজে দেখবেন সামাজিক বন্ধন ঢিলা, কারণ পর্যটন-বান্ধব হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে মানুষকে তাদের নিজেদের মত আমদ-ফুর্তি করতে দেওয়া, যার যার তার তার মত কোন দিকে না তাকিয়ে নিজের চরকায় তেল দেওয়া। এটা আমাদেরকে দিয়ে হবে না। হওয়ার দরকারও নাই।
বিতর্কের অবকাশ আছে বৈকি, তবে আমার মনে হয় এদেশে পর্যটনের বহুল বিকাশ না হলেই বরং ভালো। এর পেছনের ৩টা কারণ বলি,
১। পর্যটন নির্ভরতা আমাদের অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মনে আছে, বাংলাদেশ কোভিডের ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি? একটা বিরাট কারণ ছিল আমাদের অর্থনীতি পর্যটন-নির্ভর না। তাই, ২০২০-২১শে মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, নেপাল, থাইল্যান্ডের মতো
গভীর সমস্যায় আমাদের পড়তে হয়নি।
২। পর্যটনমাত্রই তার কিছু পরিবেশগত ক্ষতিকর প্রভাব থাকে। ওসব ইকো-ফিকো সব ভুয়া। পর্যটন-নির্ভর সব দেশে এইটা একটা বড় সমস্যা। আমাদের জনসংখ্যার চাপে পরিবেশের ইতোমধ্যেই ত্রাহি মধুসুদন অবস্থা। তার উপর যদি সভ্য-অসভ্য পর্যটকেরা এসে পলিথিন ছিটায় আর তেল পোড়ায়, তাহলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।
৩। আমাদের দেখার মত যা কিছু আছে, সেগুলো যদি শুধু নিজেরাই দেখা শুরু করি তাহলেই এই যায়গাগুলোর ধারণক্ষমতা পার হয়ে যাবে, যাচ্ছে ইতোমধ্যেই। চিপ্সের প্যাকেট, পানির বোতল আর হাগুতে ভেসে যাবে চারিদিক। সেখানে বিদেশি পর্যটকরা আসতে শুরু করলে শুরুর আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। আমাদের জনঘনত্ব আর পর্যটন উপযোগী এলাকার রেশিও অন্য দেশগুলোর সাথে তুলনা করলেই এই চিত্রের ভয়াবহতা টের পাওয়া যাবে।
তাই আমার মতে এসব পর্যটন-ফর্জটনের উন্নয়নের চিন্তা বাদ দিয়ে চুপচাপ সার্ভিস দেওয়া শিখতে হবে, আর পরিবশবান্ধব ও সংরক্ষণ-ভিত্তিক উন্নয়ন শিখতে হবে। তার আগে দেশি-বিদেশি মানুষ হাওড়-বাওড়ে, বনে বাদাড়ে যত কম হাগে ততই মঙ্গল। তবে এই আলোচনা ও বিতর্ক ছবির এই জাল টানাটানিরমত চলতে থাকুক, যতদিন এই যায়গাগুলো টিকে থাকে।